আজ মঙ্গলবার, ০৫ ডিসেম্বর ২০২৩, ১০:৩৬ পূর্বাহ্ন
বাসেত তনু (বগুড়া থেকে)
কালিপদ মজুমদারের দাদা ইংরেজ কর্তৃক তাঁর জমিদার প্রাপ্ত হন সতেরো শতকের মাঝামাঝি সময় । বাবা পিয়ারী লাল মজুমদার (ভূমি রেজিস্ট্রার) দুই ছেলে কুমদরঞ্জন মজুমদার বর্তমান ভারতের মামাবাড়ি নবদ্বীপে হুনুমান আর বানরের পদচারণ খ্যাত দর্শনীয় স্থানের বাসিন্দা। অন্য জন কালিপদ মজুমদার বগুড়ার কাহালুতে পালপাড়া সংলগ্ন কাহালু সরকারি কলেজের দক্ষিণে পুকুর ঘেঁষা প্রায় দু’শো বিঘার অসাম্প্রদায়িক চেতনা পোষণকারী প্রজা হিতৈষী মানবপ্রেমি জমিদার ছিলেন।
গোলাভরা ধান, পুকুরভরা মাছে আর গোয়ালভরা গরু পরিপূর্ণ ছিলো তাঁর জমিদারি।
সেরেস্তা নায়েব কৃষ্ণ গোপাল মহন্তের ছেলে ননী গোপাল মহন্ত প্রায় পয়তাল্লিশ বছর ধরে জমিদার কালিপদ মজুমদারের নায়েব ছিলেন। দাতব্য হোমিও সেবা নিতে দূরদুরন্ত হতে প্রজাগণ নিয়মিত সেখান ফ্রী চিকিৎসার জন্য ছুটে আসতেন। ভালো সেতারা বাদক, ফুটবল খেলোয়াড় এবং বরর্শি দিয়ে মাছধরা তাঁর শখ ছিলো। এই প্রজাহিতৈষী জমিদার সমৃদ্ধ জনপদ ১৯৭১ সালে তা লন্ড ভন্ড হয়ে যায় পাক বাহিনীর বর্বর হত্যাযজ্ঞের মাধ্যমে।
তথ্যের সন্ধানে – উলট্ট গ্রামের রেলঘুমটি আমগাছ যেখানে বর্তমান একটা মসজিদ আছে । একজন বৃদ্ধের উসখুস চাহনিতে পরিচয় পর্ব এবং আমগাছ নিয়ে কালীপদ বাবুর কথা বলতেই তিনি জানান- চিরকুমার কাহালু’র জমিদার কালিপদ যুদ্ধের সময়ে পাকিস্তান হানাদার বাহিনী কিভাবে হত্যা করে তা স্বচক্ষে দেখেন। প্রত্যক্ষদর্শী উলট্ট গ্রামের কৃষক জমশের অন্য দু’জন কৃষক শাহজান ও মোহম্মদ ওই একই গ্রামের বাদশা হাজির বাড়িত বাৎসরিক চুক্তি ভিত্তিক কৃষি কাজ করতো। বৈশাখ মাসের ২১/২২ তারিখে দিকে আউস ধান বপনের জমি চাষ করার সময় রেল গুমটির উত্তর পূর্বে মাঠে মাগুরাগাড়ি স্থানে হঠাৎ কাহালু হতে বগুড়াগামী ট্রেনটি সাড় এগারোটা সময় থামে। ট্রেন থেকে নেমে পাক হানাদার বাহিনী ওই এলাকায় কৃষকদের সরিয়ে দিয়ে ট্রেন হতে ৮/৯ জনকে কালিপদসহ পাঁচজন উকিল(কেন্দ্রীয় ব্যাংকের লুটের টাকা আছে সন্দেহে আটক )আশ্রিত ও পালপাড়ার নায়েব এর বাবা কৃষ্ণ গোপাল মহন্ত,ছেলে সুকুমার তিনজন কর্মচারী ক্যালা, কুড়ানো, অভো মহন্ত। (সপ্তম শ্রেণির পড়ুয়া সুকুমারকে স্টেশনে ছাড়া পায়) নির্মম ভাবে সবাইকে গুলিকরে হত্যা করলেও ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান বাবুর্চি অভো মহন্ত অবো।
হত্যার পর শীতলাই গ্রামের লোকজনকে দিয়ে হানাদার বাহিনী লাশগুলো মাটিচাপা দিতে বাধ্য করে।
প্রজাহিতষী কালিপদ মজুমদার বাবু উপকার করেননি/পায়নি এমন কোন মানুষ নাই এলাকায়। রবীন্দ্রোত্তর যুগে আধুনিক সেচপাম্পের সাহায্যে ২৫ বিঘা জমিতে বেগুন মরিচ ডাঙ্গা চাষ করতেন। আম,জাম, তেঁতুল,খেঁজুরগাছ, তালগাছ বেলগাছ,বাঁশঝাড় নানা ফলজ বৃক্ষসমৃদ্ধ পুকুরপাড় ঘিরে জঙ্গল যা ডিবি নামেও পরিচিত ছিলো।সাধামাঠা সাধারণজীবন-যাপন করতেন ।
৭১’র -এ মুক্তিযুদ্ধের সময় গোপনে মুক্তিবাহিনীকে সহযোগিতা করেছিলেন প্রজাদরদী এ জমিদার।
কথিত আছে তাঁর নিহত হবার দিনে সকালে বগুড়া হতে ট্রেনেযোগে পাকিস্থানী হানাদার বাহিনী কাহালুতে নামে। কাহালু বাজার,পালপাড়াও বাবুর বাড়ী আক্রান্তের আশাংকায় কালিপদ মজুমদার আত্বগোপনে লক্ষীপুরের দক্ষিণে দোকচি নামে গর্তে/খাদোতে আশ্রয় নেন। জমিদারের নিটকজন তাঁকে মিলিটারী চলে গেছে বলে ফিরে আসলে তাঁকে সহ বাড়ীতে আশ্রিত উকিল কর্মচারীকে আটক করে কাহালু রেলস্টেশনে বসিয়ে রাখে। তারপর সাঘাটা গ্রাম ও পালপাড়ায় পাক সেনারা বাড়িঘরে আগুন জ্বালিয়ে লুটতরাজও ধর্ষন কাজে লিপ্ত হয়। খান সেনার হাতে সাঘাটা, পালপাড়ায় অনন্ত দু’জন নারী ধর্ষিত হয়। পাকসেনারা লোমহর্ষক ঘটনা শেষে ট্রেনেযোগে কাহালু’র হতে তুলে নেওয়া লোকজনকে গুলি করে হত্যা করে উল্লেখিত স্থানে । জনশ্রুতি আছে কিছু কর্মচারীরা-ই সকাল সাড়ে নয়টায় সময় সকালের খাবার খেতে বসলে হানাদার বাহিনীর হাতে তুলে দেন।
শিক্ষা অনুরাগী জমিদার কাহালু হাইস্কুলের শিক্ষকতাসহ তিনি তাঁর বাড়ীতে জাগির রেখে শতশত ছাত্র লেখাপড়া করাতেন। তারমধ্য আদমদীঘির চাঁপাপুর হাউসপুরের অনিল চন্দ্র চাকী ও কাহালুর বোরতা গ্রামের সুরেন্দ্রনাথ মেট্রিক পাশ করেন এখান হতে।
সম্ভবত! জমিদার পিয়ারী লাল মজুমদারের জমিদারি পিতা হতে প্রাপ্ত। জমিদার কালিপদ মজুমদারের বাবা পিয়ারী লাল মজুমদার চাকিরীসূত্রে থাকলেও আনুমানিক ১৯৩৪/৩৫ সালের দিকে ১৯৪৭-এ দেশবিভাগের পূর্বেই বড় ছেলে কুমদরঞ্জন মজুমদারকে নিয়ে মহা মূল্যমানের বিগ্রহ মূর্তি নিয়ে নবদ্বীপে শ্বশুরালয়ে চলে যান আর মানবপ্রেমিক জমিদার কালিপদ এখানে থাকার সিদ্ধান্ত নেন।
তাঁর নিহত হবার খবর পেয়ে দেশ স্বাধীন হলে নবদ্বীপ হতে তাঁর বড়ভাই কুমদরঞ্জন মজুমদার কারো মতে ভাবী ও ভাইপো এসে জমিদারি ধরে রাখতে চেষ্টা করলেও জাসদবাহিনীর তোপে এবং লন্ড ভন্ড আইনী ব্যবস্থায় স্থানীয়দের অসহযোগিতায় সম্ভব নয় ভেবে তাঁরাও দু’মাসের মাথায় ভারতের মামাবাড়ি নবদ্বীপে চলে যান। জমিদার কালিপদ মজুমদার এর ভাইয়ের বংশধর ভারতের নবদ্বীপে এখনো টিকে আছে। কাহালুতে স্কুল কলেজ মাদ্রাসা বাজারসহ তারামিয়ার জায়গা বাদে সব স্থাপনা নিহত জমিদার কালিপদ মজুমদারের জায়গায় অবস্থিত। বর্তমানে সিংহভাগ জায়গা অবৈধ ভাবে মার্কেট বাড়ী নানা অবকাঠামোয় দখলে রেখেছে প্রভাবশালী চক্ররা। অথচ তাঁর নাম ফলকছাড়া আর কোন নিশানা পর্যন্ত নাই কোথাও।- মিলেনি শহীদের মর্যাদাও। আজ অবধি কেউ সঠিকভাবে তুলে ধরেনি কালীপদ মজুমদার বাবুর আত্মত্যাগ।
বর্তমানে হালচালঃ ২০০৫/২০০৭ সাল পর্যন্ত দ্বিতলা/তিনতলা চিলেকোঠাসহ দালান দূর হতেও দেখা যেত।
বর্তমানে তাঁর দুর্গামন্দির বহাল থাকলেও গোবিন্দ মন্দির ভেঙ্গে নতুন মন্দির নির্মিত হয়েছে। মূল ভবন ভেঙে সনাতন সংঘের প্রচেষ্টায় সংস্কৃতি মহাবিদ্যালয়ের স্থাপন করে দইয়ের স্বাদ ঘোলে মিটাবার চেষ্টা করছে!কাচারী ঘর জরাজীর্ণ অবস্থায়, দু’টি শিব মন্দির নতুন ভাবে নির্মান করা হলেও শ্রীবৃদ্ধি মোটেই ভালো না। রাস্তা দু’টি মন্দিরকে পৃথক করেছে, বাড়ির মাঝে নতুন নট মন্দির কিছুটা শ্রীবৃদ্ধি ঘটিয়েছে জমিদার কালিপদ মজুমদার এর বসতভিটাকে।